কক্সবাজার বনবিভাগ: উপকারভোগীর অর্ধকোটি টাকা আত্মসাৎ!

শাহেদ ফেরদৌস হিরু, কক্সবাজার •

কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ঈদগড় রেঞ্জের সুফল প্রকল্পের ৭টি গ্রাম সংরক্ষণ দলের ৫০০ সুবিধাভোগীর ঋনের প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগ ও নেচার কনজারভেশন ম্যানেজম্যান্টকে (নেকম) অভিযোগ দেওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে তদন্তের ৬ মাস পার হলেও এখনো কোন প্রতিকার পায়নি বলে জানিয়েছেন সুফলের ঋণ প্রকল্পের উপকারভোগীরা।

যদিও অর্ধকোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি স্বীকার করেছেন বন বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা ও নেচার কনজারভেশন ম্যানেজম্যান্টের আঞ্চলিক সমন্বয়ক ড. শফিকুর রহমান।

অন্যদিকে অর্ধকোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ আনোয়ার হোসেন সরকার বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে নিশ্চিত করেছেন একাধিক সূত্র।

বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, সুফল প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ঈদগড় রেঞ্জের ০৭ টি গ্রাম সংরক্ষণ দলের ৫০০ জন সুবিধাভোগীর মাঝে প্রতি সদস্যকে ৪২ হাজার টাকা করে ২ কোটি টাকার অধিক ঋন প্রদান কর্মসূচি গ্রহন করা হয় ২০২২-২৩ অর্থ বছরে। প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঈদগড় রেঞ্জ, সদর বিট, বাইশারি বিট ও তুলাতলী বিটের অধীনে বন নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীকে ৭টি গ্রাম সংগঠনকে বিকল্প কর্মসংস্থান ব্যাবস্থা করে বন পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে তিন ধাপে প্রশিক্ষণ করানোর জন্য নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) নামের এক এনজিও সংস্থার সাথে চুক্তি করে বনবিভাগ।

উপকারভোগীরা জানান, ঈদগড় রেঞ্জের অধীনে সুফল প্রকল্পের আওতায় ঋণদান কর্মসূচির নামে ৫০০ জন উপকারভোগীকে নেকম নামের একটি এনজিওর মাধ্যমে অনেক সেমিনার ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বনবিভাগ। প্রথমধাপে প্রতিজনকে হাস-মুরগী ও গরু-ছাগল ক্রয়ের জন্য ৪২ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়ার কথা বলে ৫০০ জন উপকারভোগীর কাছ থেকে সঞ্চয়ের নামে মাসিক ১০০ টাকা করে প্রতিমাসে ৫০ হাজার টাকা করে ৫ মাসে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন নেকমের ফিল্ড ফেসিলিটেটর মুফিদুল আলম।

তবে জানুয়ারীতে ঋণদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো কোন ঋণ পায়নি উপকারভোগীরা। উল্টো তাদের ঋণের টাকা সংগঠনের সভাপতি, বিট কর্মকর্তা, রেঞ্জ কর্মকর্তাসহ উর্ধতন কর্মকর্তা ব্যাংক একাউন্ট থেকে তুলে আত্মসাৎ করেছেন। এ বিষয়ে নেকম ও বনবিভাগের উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার অভিযোগ করলেও শীঘ্রই সমাধান করা হবে বলে ছয় মাসেও কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন উপকারভোগীরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঈদগড় রেঞ্জ, সদর বিট, তুলাতলী বিট ও বাইশারী বিটকে ৭ভাগে ভাগ করে ৫০০ জন সদস্য নিয়ে ৭টি সংগঠন করা হয়। ৭টি সংগঠনে সাবেক ইউপি সদস্য ও বনবিভাগের হেডম্যানদেরকে সভাপতি করা হয়। এবং সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিট কর্মকর্তাদেরকে সদস্য সচিব করা হয়। মূলত ৫০০ সদস্যের ঋণের টাকা সভাপতি ও সদস্য সচিবের বযৌথ ব্যাংক একাউন্টে জমা হবে সেখান থেকে সদস্যদেরকে ঋনের টাকা বন্টন করে দেওয়া হবে। তবে ঋণ প্রদানের নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলে খোজ নিয়ে জানা যায় ঋণ দেওয়ার কথা বলে মুফিদুল আলম ৭টি সংগঠনের সভাপতির চেকের পাতায় স্বাক্ষর নিয়ে বনবিভাগের কর্মকর্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে আতাত করে প্রতারণার মাধ্যমে সংগঠনের সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য শাহেনা আক্তার ও মোঃ শাহজানের সংগঠন থেকে ১৪ লাখ ১১ হাজার ২০০ টাকা করে ২৮ লাখ ২২ হাজার ৪০০ টাকা, সাবেক ইউপি সদস্য আবুল কাশেম টুলুর সংগঠন থেকে ১৭ লাখ টাকা, নুরুল ইসলামের সংগঠন থেকে ১৩ লাখ টাকা ও নুরুল আমিনের সংগঠন থেকে ১৩ লাখ টাকা সহ মোট ৭১ লাখ টাকা আত্মসাৎ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে মারমুখী আচরণ করলে তারা ১৪ লাখ ১১ হাজার টাকা ফেরত দেয়। এছাড়াও বাকী টাকা আত্মসাতের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতে শুরু করলে বিট কর্মকর্তা, রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তারা তাদের পকেট থেকে দিবে বলে আশ্বস্ত করে এবং বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলেও জানিয়েছেন সংগঠনের সভাপতিরা।

উপকারভোগীরা জানিয়েছেন তাদের এই ঋণের টাকা আত্মসাত করার সিন্ডিকেটে রয়েছেন, নেকমের ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর মুফিদুল আলম, ঈদগড় ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট শাখার ইনচার্জ, ঈদগড় রেঞ্জের তৎকালীন রেঞ্জ কর্মকর্তা মোস্তফিজুর রহমান, তৎকালীন তুলাতলী বিট কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম ফকির, বাইশারি বিট কর্মকর্তা মোঃ মোস্তফা কামাল, তুলাতলী বিট কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান, রেঞ্জ কর্মকর্তা কামরুল হাছান ও কক্সবাজার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ আনোয়ার হোসেন সরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তুলাতলী বিটের তৎকালীন কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম ফকির জানান, নেকমের একজন ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর কাটাগুলো আত্মসাৎ করেছে। আপনাদের সহযোগীতা বা স্বাক্ষর ছাড়া তো টাকা তোলার সুযোগ নেই তাহলে কিভাবে সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপকারভোগীদের ঋণের টাকা আত্মসাতের বিষয়ে আসলে সংশ্লিষ্ট বনবিভাগের কর্মকর্তারা তাই এড়াতে পারে না। তাই আমরা বনবিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই টাকাটা যেকোন ভাবে সমন্বয় করে ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করতেছি।

জানতে চাইলে ঈদগড় রেঞ্জের তৎকালীন রেঞ্জ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

জানতে চাইলে তুলাতলী বিট কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, টাকা আত্মসাতের বিষয়ে আমি অবগত নই। এ বিষয়ে রেঞ্জ কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবেন। তাছাড়া আমি এই বিটের দায়িত্ব গ্রহন করেছি টাকা আত্মসাতের ঘটনার পর অর্থাৎ ফেব্রুয়ারীতে।

জানতে চাইলে বাইশারী বিটের কর্মকর্তা মোঃ মোস্তফা কামালের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার ফোনে সংযোগ পাওয়া যায়নি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সদর বিট ও ঈদগড় রেঞ্জের কর্মকর্তা কামরুল হাছানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জানতে চাইলে ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজম্যান্ট (নেকম) কক্সবাজারের আঞ্চলিক সমন্বয়ক ড. মোঃ শফিকুর রহমান জানান, টাকা তোলার বিষয়ে অভিযোগ ও ব্যাংক স্ট্যাটমেন্টের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে আমরা ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি তারা জানিয়েছে সংগঠনের সভাপতি, রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিট কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর করা ছিলো চেক গুলোতে। এছাড়াও সব নিয়ম কানুন মেনেই টাকাগুলো উত্তোলন করেছে বাহক।

শফিকৃর রহমান আরো জানান, ৭জন প্রাক্তন ইউপি সদস্য ও সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা এবং বিট কর্মকর্তারা তো আর মূর্খ না যে তারা যে কেউ চাইলে টাকা ছাড়া চেকে স্বাক্ষর দিয়ে দিবে। এছাড়াও কয়েকজন সভাপতি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলো বিট কর্মকর্তা ও রেঞ্জ কর্মকর্তা নাকি তাদেরকে বলছে আমরাও স্বাক্ষর দিয়ে দিয়েছি তোমরাও দিয়ে দাও। তাহলে তো বুঝাই যায় কিভাবে ঘটনাটি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সবাই মিলে বসলে সমাধান বের হবে বলে মনে করেন তিনি।

অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক প্রান্তোষ চনবদ্র রায় বলেন, ভুলে টাকা গুলো অন্য একাউন্টে চলে গেছে। এটাকে আত্মসাত বলা যাবে না। খুব শীঘ্রই উপকারভোগীদের টাকা দিয়ে দেওয়া হব৷ বলে জানান তিনি।

টাকা আত্মসাতের বিষয়ে জানতে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ আনোয়ার হোসেন সরকার কোন কথা বলতে রাজি হননি। উল্টো মামলার হুমকি দেন।

জানতে চাইলে সুফল প্রকল্পের পরিচালক গোবিন্দ রায়ের একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।